বাংলাদেশে প্রতি ১০ জন প্রাপ্তবয়স্কের অন্তত ১ জনের দেহে কখনও-না-কখনও পিত্তথলিতে পাথর তৈরি হয়। অথচ বেশির ভাগ মানুষ লক্ষণ বোঝার আগেই জটিল অবস্থায় পৌঁছে যান। এই লেখায় আপনি শিখবেন—পাথর কেন হয়, কোন সংকেতগুলোকে অবহেলা করা বিপজ্জনক, কী খাবেন-কী এড়াবেন, কখন অপারেশনই শেষ কথা, আর অপারেশনের খরচ-ঝুঁকি ঠিক কতটা। শেষ পর্যন্ত পড়লে নিজের ও প্রিয়জনের জন্য তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন।
পিত্তথলিতে পাথর কী? সংক্ষিপ্ত পরিচয়
পিত্তথলি লিভারের ঠিক তলায় থাকা ছোট থলির মতো অঙ্গ, যেখানে লিভার থেকে তৈরি পিত্তরস (bile) জমা হয়। যখন পিত্তরসে কোলেস্টেরল, বিলিরুবিন আর লবণের ভারসাম্য নষ্ট হয়, তখন সেগুলো জমে কঠিন স্ফটিক তৈরি করে; এগুলিই পাথর। আকারে তারা বালুকণা থেকে পুরো টেবিলটেনিস বল পর্যন্ত হতে পারে।
সংজ্ঞা (Definition Box)
পিত্তরসে জমাট বাঁধা কোলেস্টেরল বা বিলিরুবিন-স্ফটিককে পিত্তথলির পাথর বা গলস্টোন বলা হয়।
পিত্তথলিতে পাথর কেন হয়? মূল কারণ
কারণ | ব্যাখ্যা | ঝুঁকি কতটা বেড়ে যায় |
---|---|---|
অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার | লিভার অতিরিক্ত কোলেস্টেরল প্রসেস করতে না পেরে পিত্তরসে জমা করে | ২–৩ গুণ |
হঠাৎ ওজন কমানো (ক্রাশ ডায়েট, ব্যারিয়াট্রিক সার্জারি) | পিত্তরসে কোলেস্টেরল দ্রুত বেড়ে যায় | ১৫–২৫% |
গর্ভধারণ ও জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি | ইস্ট্রোজেন পিত্তরসের গঠন বদলে দেয় | দ্বিগুণ |
পারিবারিক ইতিহাস | জেনেটিক প্রবণতা | ২৫–৩০% |
টাইপ-২ ডায়াবেটিস | ইনসুলিন-রেজিস্ট্যান্স কোলেস্টেরল বাড়ায় | ১.৫–২ গুণ |
সতর্ক সংকেত: কখন ব্যথা অবহেলা করবেন না
নিচের ১১টি লক্ষণ এক বা একাধিক মিললে দ্রুত হেপাটোবিলিয়ারি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।
- ডান পাশের পেট ও পিঠে আকস্মিক তীব্র ব্যথা
- ফ্যাটি খাবার খাওয়ার ৩০–৬০ মিনিটের মধ্যে বমিভাব
- বুক জ্বালাপোড়া ও অ্যাসিডিটি বাড়া
- চোখ-ত্বক হলুদ হওয়া (জন্ডিস)
- জ্বর-কাঁপুনি (পিত্তনালিতে সংক্রমণ)
- বাদামি থেকে ধূসর রঙের মল
- ঘন-ঘন বমি
- ডায়াবেটিসের পটভূমিতে অস্পষ্ট পেটব্যথা
- পেটে অতিরিক্ত গ্যাস ও ফাঁপা
- অস্বাভাবিক দ্রুত ওজন কমে যাওয়া
- রক্তপরীক্ষায় লিভার-এনজাইম বেড়ে যাওয়া
পিত্তথলিতে পাথর হলে কী কী সমস্যা হয়
- পিত্তনালি আটকে পিত্তরসের স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত হয়, ফলে তীব্র ব্যথা ও বমি।
- লিভার ও অগ্ন্যাশয়-দুটোই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তীব্র পানক্রিয়াটাইটিস তৈরি করতে পারে।
- দীর্ঘমেয়াদে বদহজম, অনিয়মিত ডায়রিয়া ও গ্যাসের সমস্যা বাড়ে।
খাদ্যতালিকায় সাবধানতা: কী খাবেন, কী এড়াবেন
রাখুন
- উচ্চ-ফাইবার শাকসবজি (ঢেঁড়স, পালং)
- ওমেগা-৩ সমৃদ্ধ সামুদ্রিক মাছ
- লো-ফ্যাট দই-দুধ
- লাল চাল, ওটসের মতো নন-রিফাইন্ড শস্য
এড়িয়ে চলুন
- ভাজা-পোড়া ও ট্রান্স-ফ্যাট সমৃদ্ধ ফাস্টফুড
- অতিরিক্ত মিষ্টি ও কার্বনেটেড ড্রিঙ্কস
- ক্রাশ-ডায়েট বা দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা
পেটে পাথর হলে কী খেলে ভালো হবে?
- প্রতিদিন ৮–১০ গ্লাস পানি পিত্তরস তরল রাখতে সাহায্য করে।
- সকালে ঈষদুষ্ণ পানি ও লেবুর রস কোলেস্টেরল ভাঙতে সহায়।
- হলুদের কারকিউমিন প্রদাহ কমালেও মাত্রা বজায় রাখুন।
চিকিৎসা ও অপারেশন: খরচ, প্রস্তুতি ও সাফল্যের হার
চিকিৎসা | আনুমানিক খরচ (BDT) | হাসপাতালে থাকা | সাফল্য |
---|---|---|---|
ল্যাপারোস্কোপিক চোলেসিস্টেক্টোমি | ৬০,০০০–১,২০,০০০ | ১–২ দিন | ≈ ৯৮% |
ওপেন সার্জারি | ৮০,০০০–১,৫০,০০০ | ৩–৫ দিন | ≈ ৯৫% |
ইউরসোডিওল ওষুধ | মাসে ৩,০০০–৫,০০০ | বাড়ি | ৩০–৫০% (ছোট পাথরে) |
পিত্তথলির পাথর গলানোর ঔষধ কতটা কার্যকর?
ইউরসোডিওল ৮–১২ মিমি-এর নিচের কোলেস্টেরল পাথরে ৬–১৮ মাসে কাজ করতে পারে, তবে নতুন পাথর তৈরির ঝুঁকি ৩০–৪০%। নিয়মিত আল্ট্রাসাউন্ড ও সুষম খাদ্য তাই অপরিহার্য।
অপারেশন পরবর্তী জটিলতা
- সাময়িক ডায়রিয়া বা গ্যাস
- ক্ষতস্থানে সংক্রমণ বা ব্যথা
- খুব কম ক্ষেত্রে পিত্তনালি-আঘাত (≈ ০.২%)
সঠিক বিশ্রাম, অ্যান্টিবায়োটিক ও ফলো-আপে অধিকাংশ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
পিত্তথলি না থাকলে জীবনযাত্রার পরিবর্তন
অপারেশনের পর পিত্তরস সরাসরি অন্ত্রে যায়—একসঙ্গে অতিরিক্ত ফ্যাট হজমে সমস্যা হতে পারে। সমাধান:
- ফ্যাট ভাগ করে খান, অর্থাৎ বড় মেপে নয়, ছোট ছোট ভাগে খাবার।
- উচ্চ-ফাইবার খাবার পিত্তরস পাতলা রাখতে সহায় করে।
- চিকিৎসকের পরামর্শে প্রয়োজনে এনজাইম-সাপ্লিমেন্ট যোগ করুন।
দ্রুত প্রশ্ন-উত্তর (AEO-ফ্রেন্ডলি)
প্রশ্ন: গলব্লাডারে পাথর হলে কী খেলে ভালো হবে?
উত্তর: কম চর্বির প্রোটিন, উচ্চ-ফাইবার শাক-সবজি, পর্যাপ্ত পানি ও সামুদ্রিক মাছ।
প্রশ্ন: পিত্তথলির পাথর অপারেশন না করলে কী হয়?
উত্তর: পিত্তনালি আটকে সংক্রমণ, লিভার ও অগ্ন্যাশয়ের মারাত্মক জটিলতা তৈরি হতে পারে।
শেষ কথা, পিত্তথলিতে পাথর ধরা পড়া মানেই আতঙ্ক নয়—সঠিক খাদ্যাভ্যাস, নিয়মিত পরীক্ষা ও সময়মতো সার্জারি সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি। আজ জানলেন লক্ষণ, কারণ, চিকিৎসা আর অপারেশন পরবর্তী যত্ন। এখনই নিজের ও প্রিয়জনের যত্ন নিন, পোস্টটি শেয়ার করুন এবং নিচে মতামত জানাতে ভুলবেন না!