আপনি কি জরায়ু ক্যান্সার নিয়ে উদ্বিগ্ন? এই রোগটি বিশ্বব্যাপী নারীদের মধ্যে চতুর্থ সবচেয়ে সাধারণ ক্যান্সার। তবে সুখবর হলো, এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ যা সঠিক জ্ঞান ও সচেতনতার মাধ্যমে এড়ানো সম্ভব। এই বিস্তারিত গাইডে আপনি জানতে পারবেন জরায়ু ক্যান্সারের কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং প্রতিরোধের কার্যকর উপায়গুলো। আসুন এই গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য বিষয়ে বিস্তারিত জেনে নিই।
জরায়ু ক্যান্সার কী এবং কেন হয়?
জরায়ু ক্যান্সার হলো জরায়ুমুখ বা সার্ভিক্সে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি। জরায়ুর নিচের অংশ যা যোনিপথের সাথে সংযুক্ত থাকে, তাকে সার্ভিক্স বলা হয়। এই অংশেই ক্যান্সার কোষগুলো প্রথমে গড়ে ওঠে এবং পরবর্তীতে শরীরের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে যেতে পারে।
কার্যত সকল জরায়ু ক্যান্সারের ৯৯% ক্ষেত্রেই হিউম্যান প্যাপিলোমাভাইরাস (এইচপিভি) সংক্রমণের সাথে সম্পর্ক রয়েছে। এইচপিভি ১৬ এবং ১৮ স্ট্রেইন বিশ্বব্যাপী প্রায় ৭০% জরায়ু ক্যান্সারের জন্য দায়ী। তবে মনে রাখতে হবে, এইচপিভি সংক্রমণ হলেই যে ক্যান্সার হবে তা নয়—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা এই ভাইরাসকে নিয়ন্ত্রণ করে ফেলে।
জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকির কারণসমূহ
এইচপিভি ছাড়াও আরও কিছু বিষয় জরায়ু ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়:
- ধূমপান: ধূমপায়ী নারীদের ঝুঁকি দ্বিগুণ
- দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা: এইচআইভি বা অন্যান্য কারণে
- দীর্ঘমেয়াদী জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি: ৫ বছরের বেশি ব্যবহারে ঝুঁকি তিনগুণ বৃদ্ধি
- একাধিক যৌনসঙ্গী: যৌন সংক্রামিত রোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি
- অল্প বয়সে যৌন জীবন শুরু: ১৮ বছরের আগে
- বহু সন্তান প্রসব: সাত বা ততোধিক গর্ভধারণে ঝুঁকি চারগুণ
জরায়ু ক্যান্সারের লক্ষণ ও উপসর্গ
প্রাথমিক পর্যায়ে জরায়ু ক্যান্সার সাধারণত নীরব থাকে—কোনো স্পষ্ট লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এজন্যই একে ‘নীরব ঘাতক’ বলা হয়। তবে রোগ যত অগ্রসর হয়, তত স্পষ্ট উপসর্গ দেখা দেয়।
প্রাথমিক পর্যায়ের লক্ষণগুলো
- অস্বাভাবিক যোনি রক্তপাত: মাসিকের বাইরে, যৌন মিলনের পর বা মেনোপজের পরে
- ভারী ও দীর্ঘস্থায়ী মাসিক: স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি রক্তক্ষরণ
- অস্বাভাবিক যোনি স্রাব: জলযুক্ত, রক্তাক্ত ও দুর্গন্ধযুক্ত
- যৌন মিলনের সময় ব্যথা: ডিসপ্যারুনিয়া বা কষ্টসঙ্গম
উন্নত পর্যায়ের লক্ষণসমূহ
- শ্রোণিদেশে বা নিম্ন পেটে ব্যথা: ক্রমাগত ও তীব্র ব্যথা
- কোমর বা পায়ে ব্যথা: বিশেষত দুই পায়ে
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা: অনবরত অবসাদ অনুভব
- ওজন কমে যাওয়া: অকারণে দ্রুত ওজন হ্রাস
- খাবারে অরুচি: স্বাভাবিক খিদে কমে যাওয়া
- পায়ে ফোলাভাব: উভয় পায়ে তরল জমে ফুলে যাওয়া
গুরুত্বপূর্ণ সতর্কতা: এই লক্ষণগুলো দেখা দিলেই যে ক্যান্সার হয়েছে তা নয়। অন্যান্য কারণেও এসব উপসর্গ হতে পারে। তবে এই লক্ষণগুলো থাকলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয় ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা
জরায়ু ক্যান্সার নির্ণয়ের জন্য বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। এগুলোর মধ্যে রয়েছে:
স্ক্রিনিং পরীক্ষা
- প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট: জরায়ুমুখ থেকে কোষ সংগ্রহ করে পরীক্ষা
- এইচপিভি টেস্ট: ভাইরাসের উপস্থিতি নির্ণয়
- ভায়া টেস্ট: বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে করা হয়
নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা
- কলপোস্কোপি: বিশেষ যন্ত্র দিয়ে জরায়ুমুখ পরীক্ষা
- বায়োপসি: টিস্যুর নমুনা সংগ্রহ করে ল্যাবে পরীক্ষা
- মেডিকেল ইমেজিং: সিটি স্ক্যান, এমআরআই বা পেট স্ক্যান
জরায়ু ক্যান্সারের পর্যায় ও বেঁচে থাকার হার
জরায়ু ক্যান্সারকে চারটি প্রধান পর্যায়ে ভাগ করা হয়:
ক্যান্সারের পর্যায়বিভাগ
- পর্যায় ১: ক্যান্সার কেবল সার্ভিক্সে সীমাবদ্ধ
- পর্যায় ২: ক্যান্সার জরায়ুমুখ ও যোনির নিচের অংশে বিস্তার
- পর্যায় ৩: ক্যান্সার শ্রোণি প্রাচীর বা যোনির নিচের তৃতীয়াংশে ছড়িয়েছে
- পর্যায় ৪: ক্যান্সার মূত্রাশয়, মলাশয় বা শরীরের দূরবর্তী অংশে বিস্তার
জরায়ু ক্যান্সার হলে কতদিন বাঁচে?
পর্যায় অনুযায়ী ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার:
- পর্যায় ১A: ৯৩%
- পর্যায় ১B: ৮০%
- পর্যায় ২A: ৬৩%
- পর্যায় ২B: ৫৮%
- পর্যায় ৩A: ৩৫%
- পর্যায় ৩B: ৩২%
- পর্যায় ৪A: ১৬%
- পর্যায় ৪B: ১৫%
সামগ্রিকভাবে জরায়ু ক্যান্সারের ৫ বছরের বেঁচে থাকার হার ৭৪%। বাংলাদেশে এই হার ৭১.২%।
জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা পদ্ধতি
জরায়ু ক্যান্সারের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের পর্যায়, রোগীর বয়স ও সার্বিক স্বাস্থ্যের উপর। প্রধান চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো হলো:
অস্ত্রোপচার (সার্জারি)
- কনাইজেশন: প্রাথমিক পর্যায়ে সার্ভিক্সের অংশ কেটে ফেলা
- র্যাডিকাল ট্র্যাকেলেক্টমি: সার্ভিক্স অপসারণ, জরায়ু বজায় রাখা (বাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে থাকলে)
- হিস্টেরেক্টমি: সম্পূর্ণ জরায়ু অপসারণ
- পেলভিক এক্সেন্টারেশন: উন্নত পর্যায়ে আশপাশের অঙ্গ সহ অপসারণ
রেডিয়েশন থেরাপি
- বাহ্যিক রেডিয়েশন: শরীরের বাইরে থেকে রশ্মি প্রয়োগ
- ব্র্যাকিথেরাপি: সরাসরি ক্যান্সার টিস্যুতে রেডিয়েশন
কেমোথেরাপি
- ওষুধের মাধ্যমে: ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করার জন্য বিশেষ ওষুধ প্রয়োগ
- টার্গেটেড থেরাপি: নির্দিষ্ট ক্যান্সার কোষকে লক্ষ্য করে
জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধের উপায়
সুখের বিষয় হলো, জরায়ু ক্যান্সার একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ। এটি প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপগুলো হলো:
এইচপিভি টিকা গ্রহণ
জরায়ু ক্যান্সারই একমাত্র ক্যান্সার যার টিকা রয়েছে—এইচপিভি ভ্যাকসিন। টিকার মাত্রা:
নিয়মিত স্ক্রিনিং
- ২১ বছর বয়স থেকে: নিয়মিত প্যাপ স্মিয়ার টেস্ট
- ৩০ বছরের পর: এইচপিভি টেস্ট সহ
- বাংলাদেশে: সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ভায়া পরীক্ষা
জীবনযাত্রার পরিবর্তন
- ধূমপান বর্জন: ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমায়
- নিরাপদ যৌন সম্পর্ক: কনডোম ব্যবহার ও একগামিতা
- পুষ্টিকর খাবার: রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
- নিয়মিত ব্যায়াম: সার্বিক স্বাস্থ্য ভালো রাখা
বাংলাদেশে জরায়ু ক্যান্সারের অবস্থা
বাংলাদেশে জরায়ু ক্যান্সারের পরিস্থিতি বেশ উদ্বেগজনক। এটি মহিলাদের মধ্যে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্যান্সার, যার প্রভাবে ১০.৬% আক্রান্ত হয় এবং ৫.২% মৃত্যুহার রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সারে মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
সরকারি উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার জরায়ু ক্যান্সার প্রতিরোধে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে:
- জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিনামূল্যে ভায়া পরীক্ষা
- সচেতনতা বৃদ্ধির কর্মসূচি
- প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ
জরায়ু ক্যান্সার নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা
ভুল ধারণা ১: “শুধু বয়স্ক নারীদের হয়”
সত্য: যেকোনো বয়সের নারীর হতে পারে, তবে ৩৫-৫৫ বছর বয়সে বেশি ঝুঁকি।
ভুল ধারণা ২: “একবার হলে মৃত্যু অবধারিত”
সত্য: প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়লে ৯৩% ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
ভুল ধারণা ৩: “টিকা নিলে আর স্ক্রিনিং লাগে না”
সত্য: টিকা নেওয়ার পরও নিয়মিত স্ক্রিনিং করা জরুরি।
কখন চিকিৎসকের কাছে যাবেন?
নিম্নলিখিত লক্ষণগুলোর যেকোনো একটি দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:
- মাসিকের বাইরে অস্বাভাবিক রক্তপাত
- যৌন মিলনের পর রক্তপাত
- দুর্গন্ধযুক্ত যোনি স্রাব
- তলপেটে বা কোমরে ক্রমাগত ব্যথা
- যৌন মিলনের সময় ব্যথা
মনে রাখবেন, প্রাথমিক পর্যায়ে নির্ণয় হলে জরায়ু ক্যান্সার সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য।
জরায়ু ক্যান্সার একটি গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা হলেও সঠিক জ্ঞান, সচেতনতা ও নিয়মিত স্ক্রিনিংয়ের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ ও নিরাময় সম্ভব। এইচপিভি টিকা নিন, নিয়মিত চেকআপ করান এবং সুস্বাস্থ্যের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিন। আপনার পরিবার ও বন্ধুদের মধ্যেও এই গুরুত্বপূর্ণ তথ্যগুলো শেয়ার করুন—কারণ সচেতনতাই সবচেয়ে বড় প্রতিরক্ষা।