বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যে মা মনসা পূজা একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। শ্রাবণ মাসের শেষ দিকে যখন বর্ষার প্রকোপ চলতে থাকে, তখনই সর্পদেবী মা মনসার আরাধনা শুরু হয়। এই পূজা শুধুমাত্র ধর্মীয় আচার নয়, বরং বাংলার সংস্কৃতি ও লোকবিশ্বাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। সাপের ভয় থেকে মুক্তি, সন্তান লাভের আশীর্বাদ এবং পারিবারিক কল্যাণের জন্য ভক্তরা মা মনসার কাছে প্রার্থনা করেন। আজকের এই বিস্তারিত আলোচনায় আমরা জানব মা মনসা পূজার সম্পূর্ণ পদ্ধতি, তার তাৎপর্য এবং ২০২৫ সালের পূজার তারিখ সম্পর্কে।
মা মনসার পরিচয় ও মাহাত্ম্য
মা মনসা হিন্দু ধর্মের অন্যতম প্রাচীন লৌকিক দেবী। পুরাণ অনুযায়ী, তিনি ঋষি কশ্যপের মানসকন্যা এবং নাগরাজ বাসুকীর ভগিনী। তবে মঙ্গলকাব্যে তাঁকে ভগবান শিবের মানসকন্যা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবী ভাগবত পুরাণে উল্লেখ রয়েছে যে মা মনসার জন্ম পদ্মপাতায় হয়েছিল বলে তাঁর আরেক নাম পদ্মাবতী।
সর্পদেবী হিসেবে মা মনসার প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় অথর্ববেদে। তিনি সর্প ও সরীসৃপদের দেবী হিসেবে ব্রহ্মা কর্তৃক নিযুক্ত হয়েছিলেন। মা মনসার স্বামী জগৎকারু মুনি এবং তাঁদের একমাত্র পুত্রের নাম আস্তিক, যিনি পরবর্তীতে রাজা জনমেজয়ের সর্পনিধন যজ্ঞে নাগদের রক্ষা করেছিলেন।
২০২৫ সালে মা মনসা পূজার তারিখ ও সময়
পঞ্জিকা অনুযায়ী, ২০২৫ সালে মা মনসা পূজা দুটি প্রধান দিনে পালিত হবে:
প্রথম তারিখ: ২৯ জুলাই, ২০২৫ (মঙ্গলবার)
- বাংলা তারিখ: ১২ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
- উপলক্ষ: নাগপঞ্চমী
দ্বিতীয় তারিখ: ১৭ আগস্ট, ২০২৫ (বুধবার)
- বাংলা তারিখ: ৩১ শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
- উপলক্ষ: অষ্টনাগ পূজা
অনেক অঞ্চলে শ্রাবণ ও আষাঢ় মাসের প্রতিটি পঞ্চমী তিথিতে মা মনসার পূজা করার রীতি প্রচলিত রয়েছে। কোথাও কোথাও একমাস ধরে এই পূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।
মা মনসা পূজার পদ্ধতি ও নিয়মাবলী
পূজার প্রস্তুতি
সাধারণত মা মনসার প্রতিমায় পূজা করা হয় না। বরং স্নুহী বা সীজ বৃক্ষের ডালে অথবা বিশেষভাবে সর্পচিত্রিত ঘট বা ঝাঁপিতে মা মনসার পূজা হয়ে থাকে। কোনো কোনো স্থানে নদীর মাটি দিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে দেবীর মূর্তি তৈরি করা হয়।
পূজার উপকরণ
মা মনসা পূজার জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণগুলি হল:
- সিন্দুর, ঘট, মনসাগাছ বা তার ডাল
- পূজার শাটী, মধুপর্কের বাটী
- মধু, ঘৃত, দধি, তিল
- হরিতকী, পুষ্প, দূর্বা, তুলসী, বিল্বপত্র
- ধূপ, দীপ, বড় নৈবেদ্য
- অষ্টনাগের নৈবেদ্য (৮টি)
- দুধ, কলা ও অন্যান্য ফল
পূজার বিধি
প্রথমে হাতের তালুতে জল নিয়ে “ওঁ বিষ্ণু” মন্ত্রে তিনবার জল পান করতে হয়। এরপর করজোড়ে বিশেষ মন্ত্র উচ্চারণ করে পূজা শুরু করা হয়। মস্তকে তুলসী রেখে দেবীর আরাধনা করা হয়।
মা মনসার কাহিনী: চাঁদ সওদাগরের গল্প
বাংলার লোককাহিনীতে মা মনসা পূজার প্রচলনের পেছনে রয়েছে চাঁদ সওদাগরের বিখ্যাত কাহিনী। পুরাণ অনুযায়ী, মা মনসা শিবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন যেন তাঁকে মানুষ পূজা করে। শিব জানিয়েছিলেন যে, চাঁদ সওদাগর তাঁকে পূজা করলেই তাঁর ইচ্ছা পূরণ হবে।
চাঁদ সওদাগর শিবের পরম ভক্ত ছিলেন কিন্তু মা মনসার পূজা করতে অস্বীকার করেছিলেন। ফলে মা মনসার রোষে পড়ে তাঁর ছয় পুত্র সাপের কামড়ে মারা যায় এবং তাঁর ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যায়।
পরবর্তীতে তাঁর সপ্তম পুত্র লক্ষিন্দরের সাথে বেহুলার বিবাহ হয়। বিবাহের রাতেই লোহার বাসরঘরে মা মনসা কালনাগিনী দিয়ে লক্ষিন্দরকে হত্যা করান। বেহুলা স্বামীর লাশ নিয়ে ভেলায় করে ইন্দ্রপুরীতে গিয়ে নৃত্য করে দেবতাদের তুষ্ট করেন। দেবতারা শর্ত দেন যে চাঁদ সওদাগর মা মনসার পূজা করলেই লক্ষিন্দরের প্রাণ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। শেষ পর্যন্ত চাঁদ সওদাগর বাধ্য হয়ে মা মনসার পূজা শুরু করেন এবং পুত্রদের প্রাণ ও হারানো ঐশ্বর্য ফিরে পান।
মা মনসা পূজার তাৎপর্য ও উপকারিতা
সর্পভীতি নিবারণ
বর্ষাকালে সাপের উপদ্রব বেশি থাকে বলে এই সময়ই মা মনসার পূজা বিশেষভাবে প্রচলিত। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে এই পূজা করলে সর্পদংশনের ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
সন্তান প্রাপ্তির আশীর্বাদ
মা মনসাকে সন্তান কামনার দেবী হিসেবেও পূজা করা হয়। যাদের সন্তান নেই, তারা এই পূজায় অংশ নিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেন।
রোগমুক্তি ও কল্যাণ
কোথাও কোথাও মা মনসাকে রোগমুক্তির প্রতীক হিসেবে পূজিত হতে দেখা যায়। ভক্তরা পারিবারিক কল্যাণ ও সুখ-শান্তির জন্যও তাঁর আরাধনা করে থাকেন।
বিভিন্ন অঞ্চলে মা মনসা পূজার রীতি
পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে মা মনসার পূজার ভিন্ন ভিন্ন রীতি প্রচলিত রয়েছে। বিশেষ করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলায় এই পূজা বহুল প্রচলিত। গ্রামাঞ্চলে মা মনসার মন্দিরও দেখতে পাওয়া যায়।
কোথাও কোথাও জীবন্ত সাপের পূজা করা হয়। অনেক ভক্ত শরীরে সূচ ফুঁড়ে বা কষ্ট সহ্য করে ব্রত পালন করেন। নাগপঞ্চমীর দিন বাঙালি মহিলারা উপবাস ব্রত করে সাপের গর্তে দুধ ঢালার রীতিও রয়েছে।
মা মনসার মূর্তিতত্ত্ব ও প্রতীকী অর্থ
মা মনসার মূর্তিতে তিনি সর্বাঙ্গে সর্পাভরণভূষিতা এবং পদ্ম অথবা নাগপৃষ্ঠে আসীনা দেখা যান। তাঁর মাথার উপর সপ্তফণাযুক্ত নাগছত্র থাকে। কখনো কখনো তাঁর কোলে একটি শিশুকেও দেখা যায়, যা তাঁর পুত্র আস্তিক বলে মনে করা হয়। মা মনসাকে “একচক্ষু কানা” দেবীও বলা হয়, কারণ তাঁর একটি চোখ সৎ-মা চণ্ডী কর্তৃক দগ্ধ হয়েছিল।
আধুনিক যুগে মা মনসা পূজার প্রাসঙ্গিকতা
আজকের যুগেও মা মনসা পূজা বাংলার সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শহুরে জীবনেও অনেক পরিবার এই ঐতিহ্যবাহী পূজা পালন করে থাকেন। এই পূজা কেবল ধর্মীয় আচার নয়, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়ের একটি অংশ।
বর্তমানে পরিবেশ সচেতনতার যুগে মা মনসার পূজা প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি মাধ্যম হিসেবেও দেখা যেতে পারে। সাপ যেমন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি এই পূজার মাধ্যমে আমরা প্রকৃতির সাথে সামঞ্জস্য বজায় রাখার শিক্ষা পাই।
মা মনসা পূজা বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্যের একটি অমূল্য সম্পদ। এই পূজার মধ্য দিয়ে আমরা শুধু ধর্মীয় কর্তব্য পালনই করি না, বরং আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকেও জীবন্ত রাখি। ২০২৫ সালের আগামী ২৯ জুলাই ও ১৩ আগস্ট তারিখে যারা এই পবিত্র পূজায় অংশগ্রহণ করবেন, তারা মা মনসার আশীর্বাদে ধন্য হবেন এবং জীবনে সুখ-শান্তি লাভ করবেন। আসুন, আমরা সকলে মিলে এই ঐতিহ্যবাহী পূজা পালন করে আমাদের সংস্কৃতিকে এগিয়ে নিয়ে যাই।